প্রাচীনকালে সাধারণের মধ্যে শিক্ষার তেমন কোন প্রচলন ছিল না। তবে গ্রাম্য বর্মনদের মধ্যে বেদ উপনিষদ কেন্দ্রিক শিক্ষার প্রচলন ছিলো। যার যুক্তি হিসাবে বলা যায় সপ্তম শতকে য়ুয়ান-চোয়াঙ পুণ্ড্রবর্ধন ও কামরুন ভ্রমণকালে ব্যাপক শিক্ষা প্রসারের কথা উল্লেখ করেছেন। যা এ অঞ্চলের শিক্ষার সাক্ষ্য বহন করে। ব্রিটিশ অব্যাবহিত পূর্বকালে ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে গৃহকেন্দিক টোল ও মক্তবের অস্তিত্ব ছিল বলে প্রতীয়মান হয়।
নতুন ধান ঘরে তোলার সময় নবান্ন, বিপদে আপদে সত্যপীরের সিন্নি, ভাদই ধান কাটা হলে চালের গুঁড়ো খাওয়ার উৎসব, অশুভশক্তির হাত থেকে রক্ষার জন্য তাবিজ ও কবজ, বিয়ে উপলক্ষে খৈনচা খাওয়া, গাঁয়ে হলুদের উৎসব, খেলাধুলার মধ্যে চিল্লাচিল্লি, ঘুটুঘুটু, হাডুক ডুক, চেঙ্গা পাইট, ভেদা পাইট, ডাঙ্গা পাইট, ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ছিল। গানের ক্ষেত্রে এ অঞ্চল ছিল গান পাগল মানুষের অঞ্চল। ধামের গান, বিয়ের গান, সত্যপীরের গান, চরক পূজার গান ইত্যাদি ছিল অন্যতম। প্রাচীন পুঁথিতে এ অঞ্চলে ৪২ (বিয়াল্লিশ) ধরনের বাজনার নাম পাওয়া যায়। উল্লেখযোগ্য বাজনা হলো:- শঙ্খ, ঘন্টা, করতাল, দুন্দুভি, ঢাক, ঢোল, ডগর, নাগারা, রামবেনা(বীণা), খঞ্জরিকা, মোহরী, দোতারাম, রবাব, সারিন্দা, বাঁশী, ঝিল্লি, ঝিঞ্জিরি, কারাশী, রুদ্রক টোকারী, তুরী, মৃদঙ্গ, মন্দিরা, খোল, ধোমচি, গোগোনা, মুরুরী(মুরলী), উপাঙ্গ, বড়কাঙ্খ, মুচর, জম্ফ, জয়কালী, ভেরী, রামশিঙ্গা, রামতাল, ঝোঞ্জারা, গোমুখ, বীরকালী, সিংহাবাণ, তবল, দোচরী, উরুলী এবং ঢোলক প্রভৃতি।
এছাড়া লোকসাহিত্যের প্রাচীনতম নির্দশন ছড়া। আগের দিনের মানুষেরা যে কোন বিষয়কে কথার মাধ্যমে মিলিয়ে উচ্চারণ করতেন। যা মূলত ছড়া। ছড়াগুলো শিশুদের জন্য হলেও বড়দেরও আনন্দদান করে। এগুলো সাধারণত অর্থহীন, কিন্তু কোন সময় ইঙ্গিতে অর্থ প্রকাশ করে।
১। মাছের মধ্যে রুই, শাকের মধ্যে পুঁই,
ডাইলের মধ্যে ঠাকুরী, কুটুমের মধ্যে শাশুড়ি।
২। দিনডায় বেড়ালো ওলো ঢোলো করে
জোনাকত শুকালো ধান,
আনগে বেটি ছাম-গাহিন,
তোর বাপে কুটুক ধান।
৩। শাশুর না ননন কাকে করিম ডর,
আগুত খাম পান্তা পানি পাছুত কুড়াম ঘর।
ধাঁধা:-
ধাঁধা বলা হয় লোকসাহিত্যের জীবন্ত অংশ। ধাঁধার মাধ্যমে যে রসের সৃষ্টি হয় তা সত্যিই উপভোগ্য। গ্রাম ও শহরের ছোটরা তো বটেই বড়রাও একে অন্যকে ছড়া কেটে ধাঁধা জিজ্ঞেস করে ঠকায়।
১। লোহার গাই লোহার বাছুর,
দুধ ছেকে তোর মামা শুশুর।
উত্তর:- টিউবয়েল।
২। আল্লাহ্র কি কুদরত,
লাঠির ভেতর সরবত।
উত্তর:- আখ(কুশার)
৩। দুই চালর এক বাতা।
উত্তর:- কলার পাতা।
প্রবাদ প্রবচন
মানুষের সূক্ষতম অভিজ্ঞতার ফসল প্রবাদ প্রবচন। এর মাধ্যমে মানুষ নিজের চলমান জীবনের প্রয়োজনীয় উপলব্ধি ছড়িয়ে দেয় অন্যকে। মানুষ তা জড়িয়ে নেয় জীবনের সাথে।
১। মাঘ মাসের জারে
ভুঁইষের শিং নড়ে।
২। ভাত খায় ভাতারের
গীত গায় নাঙ্গের।
৩। নি খাম নি খাম বালি
খায় সাড়ে তিন থালি।
বিয়ের গীত:-
এসব গীতের কোন রচয়িতা ও সুরকার নেই। কোন প্রশিক্ষনের প্রয়োজন হয় না। কোন বাদ্য যন্ত্রের প্রয়োজন পড়ে না। বিয়েতে বর-কনে উভয়ের বাড়িতে গীত গাওয়া হয়।গায় হলুদ, বরগমন, কনে বিদায়, বধূবরণ সবক্ষেত্রেই গীত গায় কেবল মহিলারা।
১। কন্যা ডাক দেও তোন জননী না মাইরে,
মাও দিয়া যাউক সোনা মুখে হলদিরে।
হলদা ডাক দাও তোর জনমদাতা বাপেরে,
বাবা দিয়া যাউক তোর সোনামুখে হলদিরে।
২। হামার ভাইর হলদি মাখিবার, মনে নাহি ছিলরে
জোর-বেজোর হলদি মাখালে, জোনাকু শালারর বহিনরে।
লোকসংগীত:-
শাক তুলিবা গেনু গে মুই
কলার ছুয়াডাক নিয়া,
শাক তুলা যেমন তেমন
ফাটে যায় মোর হিয়া।
এত করে শাক আন্ধেচু
শাকত্ নাই দেঁও নুন।
হামার বাড়ির বুড়াটার
গেদের গেদের শুন্।
ধামের গান:-
ওকি মাইগে রসবালা
কিনে দিম তোক সোনার মালা
মুই ছাড়া তোক ভুলাবে কোন শালা।
পালাগান:-
প্রেমিকা: মুই তো যাছু দাদা নাগর নদীর ঘাটে
তুই পালাছিত দাদা দূরে দূরে রে।
ও মোর দাদারে,
গসা হলো কিবা দোষে রে।
প্রেমিক: ও মাই নয়ন গে,
গসা নাই হঁও যাছুগে মুই বাড়ি
সকালে মুই আইচ্চু এ্যাত্তি
হোর বেলাটা গেল গে গড়ি
দেরি করে বাড়ি গেলে গালি দিবে
মামা আর মামী।
সংস্কৃতি ছাড়া কোন জাতির অস্তিত্ব টিকে থাকতে পারে না। তবে সংস্কৃতি যেহেতু পরিবর্তনশীল, সেহেতু লোক-সংস্কৃতিরও বির্বতন ঘটবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আজ যান্ত্রিক সভ্যতার চাপে আমাদের লোক সংস্কৃতি বিলুপ্ত হতে চলেছে।আমাদের সংস্কৃতির সাথে সাথে লোক সংস্কৃতির লালনে আরো যত্নবান ও আন্তরিক হতে হবে এবং এর মাধ্যমেই অপ-সংস্কৃতির আগ্রাসনকে রোধ করা সম্ভব হবে।